তাওহীদুল ইসলাম নূরী:
সংস্কৃতি চর্চা প্রতিটি জাতি, দেশ ও জনতার চিত্তের খোরাক এবং উপকারী। কিন্তু, এই সংস্কৃতি যদি শরীয়াত পরিপন্থী হয় তাহলে দেশ ও জাতির জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। আমাদের দেশ এবং সাম্প্রতিক বিশ্বে এমন একটি শরীয়াত পরিপন্থী গোনাহের নাম গান-বাজনা।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর মুসলিম দেশ আমাদের বাংলাদেশ। কিন্তু আজকাল আমাদের দেশের প্রায় সকল মানুষের কাছে গান-বাজনা, সিনেমা-নাটক অন্যতম একটি সংস্কৃতি ও চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে স্থান পেয়েছে। গান-বাজনা সম্পর্কে আমরা ভেবেছি কি? ভাবার প্রয়োজনীয়তাও কখনো অনুভব করেছি কি? যদি উত্তর না হয় আসুন শরীয়াতের চারটি উৎস থেকে আজ গান-বাজনা সম্পর্কে একটু আলোচনা করি।

প্রথমে মানবতার পথ নির্দেশক আল-কোরআনের দিকে মনোনিবেশ করি। দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যাবে যে, উক্ত কিতাবের সূরা লোকমানের ০৬ নম্বর আয়াত দ্বারা গান-বাজনাকে ইঙ্গিত দিয়ে যারা এসবের সাথে জড়িত থাকবে ওদের কঠিন পরিণতির কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটিতে যদিওবা স্পষ্টরূপে গান-বাজনার কথা বলা হয় নি, তবে আলোচ্য আয়াতটিতে “লাওহাল হাদিস” তথা বাংলায় যে বেহুদা কথা বলা হয়েছে এ সম্পর্কে বেশ কয়েকজন সাহাবী বলেন লাওহাল হাদিস বলতে মহান আল্লাহ গান-বাজনার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ সম্পর্কে বলেন “যে আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন তার শপথ লাওহাল হাদিস গান-বাদ্য ও ক্রীড়া-কৌতুক ছাড়া কিছুই নয়। হযরত ইবনে মাসুদ (রাঃ)ও পর পর তিন বার জোর দিয়ে বলেন “আল্লাহর কসম, লাওহাল হাদিস অর্থ গান”। এছাড়াও কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ লাওহাল হাদিস এই শব্দটি এনে এ সম্পর্কে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন। এদিক দিয়ে শরীয়তের অকাট্য দলিল কোরআন দ্বারা গান-বাদ্য প্রভৃতি হারাম ও বেহুদা প্রমাণিত হয়।

অন্যদিকে শরীয়াতের দ্বিতীয় উৎস হল আদর্শের বিশ্বমানব বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এর মুখনিঃসৃত বাণী অর্থাৎ হাদিস। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ হাদিস অনুসরণের জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। যেমন সূরা হাশরের ০৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন ” রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক”। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (স.) ইরশাদ করেছেন “আমার উম্মতের মাঝে এমন এক সম্প্রদায়ের উত্থান হবে যারা ব্যাভিচার,রেশম,মদ-জুয়া ও গান-বাজনাকে নির্ধিদ্বায় গ্রহণ করবে”। এখানে নির্ধিদ্বায় বলতে গুনাহমুক্ত বা হারামকে হালাল রূপে গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবতার নিরীক্ষে একটু ভাবলেই দেখা যাবে যে আমরাই সে সম্প্রদায়। আমাদের সমাজ,দেশের সর্বত্রই আজ সেসব বিশেষ করে গান-বাজনা জলের পোনার মতই ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে যে চুরি-ডাকাতি,খুন-গুম, জুলুম ছড়িয়ে পড়েছে তার মূলেই রয়েছে কোরআন-হাদিসের অনুসরণ না করা। আমরা যদি এই দুই কিতাবের অনুসরণ করতাম তাহলে নীতি-নৈতিকতার মধ্য দিয়ে বড় হতে শিখতাম। এসব অপকর্মের ছোঁয়া পর্যন্ত পেতাম না। বিপুল অর্থের কাছে হার মেনে কোরআন-হাদিসকে বাদ দিয়ে আমরা যে দেশের সর্বত্রই আজ সিনেমাহল,গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রের অনুমতি দিয়েছি সেটার জন্য মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর দরবারে কী জবাব দিব সেটা একটা বারের জন্যও ভেবেছি কি? এটার দায়ে কি কাল হাশরের ময়দানে আমাদেরকে জালিমের কাতারে দাঁড়াতে হবে না? এক্ষেত্রে হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন বিশ্বনবী ইরশাদ করেন, “আমি বাদ্যযন্ত্রকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য প্রেরিত হয়েছি”। কিন্তু আমরা সেখানে গান-বাজনাকে বাঁধা না দিয়ে মানুষকে সেটার জন্য উদ্বুদ্ধ করেই চলছি। আবার সমাজের এমন অনেক মানুষকে দেখা যায় যারা বলেন জীবিকা নির্বাহের কোন উপায় না পেয়ে তারা সিনেমা-নাটক,গান-বাজনাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। সেক্ষেত্রে হযরত আমর ইবনে কুরবাহর ঘটনাটি উল্লেখ্যনীয়। তিনি একদা বিশ্বনবীর কাছে উপস্থিত হয়ে বলেন যে ” হে আল্লাহর রাসুল, আমার কণ্ঠ অতি সুন্দর। তাই আমি গান গেয়ে উপার্জন করতে চাই এবং আমি গানকে কোন অশ্লীলতায় ব্যবহার করব না”। তখন রাসূল (স.) তাকে আল্লাহর দুশমন সম্বোধন করে বলেন, আল্লাহর দুশমন তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্লাহ তোমার জন্য কত হালাল উপার্জনের পথ রেখেছেন”। আসুন,একটু ভেবে দেখি। যে সাহাবী অশ্লীলতামুক্তভাবে গান গেয়ে উপার্জন করতে চেয়েছেন তাকে আল্লাহর নবী আল্লাহর দুশমন আখ্যায়িত করেছেন। আর আমরা যারা অশ্লীলতায় ভরা সিনেমা-নাটক,গান-বাজনার দ্বারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের চরিত্র হনন করে চলছি আমাদের অবস্থা কী হবে? হাদিসগুলো থেকে আমরা নিশ্চিত যে, গানবাদ্য,সিনেমা-নাটক দেখা যাবে না, শুনা যাবে না এবং এসবকে উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।

ইসলামি শরীয়াতে হাদিসের পরপরই ইজমার স্থান। ইজমা বলতে কোন বিষয়ে আলেম,উলামাগণের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তকে বুঝায়। আল্লাহর রাসূল (স.) বলেন, আমার উম্মতের মাঝে ৭৩টি দল তথা ফেরকার জন্ম হবে। ইতিমধ্যে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। বিভিন্ন দল বিভিন্ন মত প্রচার করে যাচ্ছেন এবং কোন কোন বিষয়ে তারা একই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছেন না। যেমন আমাদের দেশে কেউ কেউ বলেন সীরাতুন্নবী উত্তম, আবার কেউ কেউ মিলাদুন্নবীর দিকে জোর দিচ্ছেন। রাসূল (স.) মাটির না নূরের তৈরি এরকম হাজার মতানৈক্য তো আছেই। কিন্তু, গান-বাদ্য যে হারাম,বেহুদা সে বিষয়ে কোন ফেরকার কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই এবং সকলেই একমত যে গান-বাজনা যেহেতু হারাম এগুলো শুনা-দেখাও একইভাবে হারাম।

কোরআন, হাদিস, ইজমা থেকে আমরা পরিষ্কার যে গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র হারাম। এখন শুধু কিয়াসের আলোচনাই বাকী। কিয়াস বলতে অনুমান, ভাবা ও চিন্তাকে বুঝায়। একটু চিন্তা করি তো যে গান-বাজনা নিয়ে আমি লেগে থাকি সেটা কোন পথে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে? কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়ে দিন দিন আমার কী যে পরিণতি হচ্ছে! যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলে স্পষ্ট হবে যে, আমি যেটি নিয়ে পড়ে আছি সেটি হারাম,হারাম এবং হারাম বৈ আর কিছুই নয়। চিরশত্রু শয়তানের কারণেই আমি গান-বাজনাকে সঙ্গী হিসেবে নিয়েছি।

উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় শরীয়াতের চারটি উৎস থেকে আমরা এই বিষয়ে একমত যে সিনেমা-নাটক,গান-বাজনা হারাম। তাহলে এত অকাট্য দলিল পাওয়ার পরেও কি আমরা আগের সেই গোমরাহিতে পড়ে থাকব? বিশ্বনবী (স.) বলেছেন “যে যেই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, সে সেই অবস্থায় কিয়ামতে উঠবে”। সেদিক বিবেচনায় আমি যেটি নিয়ে সারাক্ষণ মত্ত থাকি আল্লাহ না করুন সে অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হয় তাহলে কেমন হবে আমার কবর,হাশর ও কিয়ামত? কারণ, আমি পড়ে থাকি মহিলা ও চরিত্রহীনদের গান-বাজনা নিয়ে। আর রাসূল (স.) বলছেন, “যারা মহিলাদের কণ্ঠের এবং তাদের নিমিত্তে রচিত গান কবিতা শুনবে তারা জাহান্নামী”। আমি আজ সচেতন। আজ থেকে শপথ নিই এই বেহুদা কর্মের সাথে নিজেকে যেমনি জড়াব না, তেমনি এটার সঙ্গে জড়িতদেরও সাধ্যমত সচেতন করব। আর দীর্ঘদিনের কৃতকর্মের স্বীকৃতি দিয়ে দয়াময় আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করব। আবার হযরত মোহাম্মদ (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন অন্যায় হতে দেখে বাঁধা না দেয়, সে যেন আল্লাহর ব্যাপক আযাবের অপেক্ষায় থাকে”।

বর্ণিত আছে, আল্লাহ একদা হযরত ইউসা বিন নুন (আঃ)কে ডেকে বলেন যে, “আমি তোমার সম্প্রদায়ের ৪০ হাজার নেককার তথা পূণ্য ব্যক্তি এবং ৬০ হাজার বদকার তথা পাপী লোককে ধ্বংস করে দেব”। তখন হযরত ইউসা বিন নুন বলেন, ‘আল্লাহ, পাপীদের বিষয়টি বুঝলাম। কিন্তু, নেককারদের কী অপরাধ? ‘। উত্তরে আল্লাহ বলেন নেককার লোকগুলো বদকারদেরকে অসৎকর্মে বাঁধা না দিয়ে বরং ওদের সাথে উঠাবসা করছে। যার জন্য পূণ্যবানদের বিষয়ে আমার এই সিদ্ধান্ত। তাহলে, বর্তমান সময়ের আমাদের অবস্থা কী হবে? বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এক বর্ণনায় বলেন, ” কোথাও অন্যায় হতে দেখলে তোমরা হাত দিয়ে বাঁধা দাও, তা না পারলে মুখ দিয়ে বাঁধা দাও, যদি তাও না পার তাহলে অন্তর থেকে সেটা উৎখাতের চেষ্টা কর”। তাই আসুন, বিশ্বনবীর হাদিস অনুযায়ী আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে আজকের আলোচ্য বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমরা জানলাম সিনেমা-নাটক,গান-বাজনায় লিপ্ত থাকা চরম গোনাহের কাজ এবং এটি হারাম। কিন্তু, এটি বাহ্যিকভাবে আমাদের কী ক্ষতি করে একটু দেখি

* আল্লাহর স্মরণ থেকে অমনোযোগী
* সময় ও অর্থের অপচয় হয়
* নৈতিকতা লোপ পায়
* অভ্যাস থেকে নেশায় পরিণত হয়
* কল্পনার জগতে হারিয়ে যায়

আমি আপনাদের খেদমতে কিছুটা সময় ব্যয় করার চেষ্টা করেছি। জানি না আমার শ্রম কতটুকু সফল হল। তবে আমি বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি আপনি এখন নিশ্চিত সিনেমা-নাটক,গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র হারাম। তাই, মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে এই হারামসহ সকল গোনাহের কাছ থেকে দূরে রেখে দুনিয়া, আখিরাত উপযোগি একজন মানুষ হিসেবে কবুল করেন। “আমিন”।

লেখকঃ
তাওহীদুল ইসলাম নূরী
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (অধ্যয়নরত)।
শাহারবিল বাজার, চকরিয়া, কক্সবাজার।